বাগমারা প্রতিনিধিঃ সৌদি আরবে সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে যাওয়া সাত জনের মধ্যে চারজনের বাড়ি রাজশাহীর বাগমারায়। বুধবার (৯ আগস্ট ২০২৩) দুপুরে তাদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনার পর কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা। পুরো গ্রাম জুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। একে একে সবার জানাযা শেষে মরদেহ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ ইউনিয়ন, বাগমারা উপজেলার ঝিকরা ইউনিয়ন, যোগীপাড়া ইউনিয়ন সীমানা এলাকা হওয়ায় আশেপাশের গ্রামের লোকজনও এক নজর মরদেহ দেখতে ভিড় জমায় নিহতদের বাড়িতে।
নিহতরা হলেন- রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার প্রবাসী গ্রাম নামে পরিচিত বারুইপাড়া গ্রামের জফির উদ্দিনের ছেলে রুবেল হোসাইন, একই এলাকার জমিরের ছেলে মোহাম্মদ সাজেদুল ইসলাম, তার ভাতিজা শাহাদাত হোসাইনের ছেলে মোঃ আরিফ হোসেন ও কাতিলা বড়মাধাইমুড়ি গ্রামের আনিসুর রহমান সরদারের ছেলে ফিরোজ আলী সরদার,
গত ১৪ জুলাই বাংলাদেশ সময় বিকেল ৪টার দিকে দাম্মামের হুফুফ শহরে একটি সোফা কারখানা অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নয়জন নিহত হন। এরমধ্যে বাংলাদেশী সাতজন, যাদের চারজন রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বারুইপাড়া ও কাতিলা বড়মাধাইমুড়ি গ্রামের বাসিন্দা।
ঠিক দশ মাস আগে মরিয়মের সাথে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভিডিও কলে বিয়ে হয় প্রবাসী রুবেল হোসাইনের। এরমধ্যে আসি আসি করেও ছুটি না পাওয়ায় বাড়ি এসে বউয়ের মুখ দেখা হয়নি তার। এবার ছুটি হয়েছে তবে চিরবিদায়ের। তাই বুধবার দুপুরে রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বাড়ইপাড়া গ্রামে রুবেলের মরদেহ আনা হয় কফিনে। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন তার স্ত্রী বোনসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা। পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনতে প্রায় ছয় বছর আগে সৌদি আরবে যান রুবেল।
এর কিছুক্ষণ আগে অ্যাম্বুলেন্সে করে আনা হয় সাজেদুল ইসলাম ও আরিফের মরদেহ। সম্পর্কে চাচা ভাতিজা তারা। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পাগল প্রায় স্বজনেরা। কফিনের গন্ধ আর পরিবারের আহাজারিতে পুরো গ্রামজুড়ে নেমে আসে কালো শোকের ছায়া। আশেপাশের এলাকাবাসীও এক নজর মরদেহ দেখতে ভিড় জমায়। পরে একে একে সবার জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মরদেহ দাফন করা হয়।
বাগমারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ এফ এম আবু সুফিয়ান বলেন, মঙ্গলবারে দিবাগত রাতে চারজনের মরদেহ ঢাকা শাহাজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। সেখান থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহগুলো নিজ নিজ বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হয়। সরকারী উদ্যোগে চারজনের মরদেহ আনা থেকে শুরু করে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সব ধরনের সহায়তার দেয়া হয়েছে।
সৌদি আরবে সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যাওয়াদের মধ্যে সাত বছরের প্রবাসী রুবেল হোসাইন নয় মাস ছয়দিন আগে মোবাইল ফোনে ভিডিও কনফারেন্সে বিয়ে করেন। প্রেম করে বিয়ে হলেও স্বামীর সঙ্গে সাক্ষাত হওয়ার আগে বিধবা হলেন কলেজছাত্রী মরিয়ম আক্তার।
মরিয়ম জানান, সর্বশেষ মারা যাওয়ার আগের রাতে তাদের শেষ কথা হয়। দেশে আসার জন্য শুক্রবার কাগজপত্র জমা দিয়ে কারখানায় যাবেন বলে স্ত্রীকে জানিয়েছিল রুবেল। শুক্রবার (১৪ জুলাই) রাতে আবার কথা বলবে বলেছিল। রাতে কলও দিয়েছিল মরিয়ম। কিন্তু ফোন বাজে কেউ রিসিভ করেনি। রাত নয়টা পর্যন্ত ফোন বেজেছে। এরপর ফোন আর বাজেনি। পরের দিন সকাল ৮টার দিকে রুবেলের প্রবাসী বড় ভাই ফোন করে জানায় রুবেল মারা গেছে।
তিন ভাইয়ের মধ্যে রুবেল সবার ছোটে। স্থানীয় দালালকে ১৬ কাঠা জমি লিখে দেওয়া ছাড়াও দেড় লাখ টাকা নগদ দিয়ে ২০১৬ সালে সৌদি আরব পাড়ি জমান রুবেল। তার বড় দুইভাই আগে থেকেই প্রবাসী। বড়ভাই সৌদি আরব এবং মেজে ভাই দুবাই থাকেন।
বারুইপাড়া গ্রামের শাহাদাত হোসাইনের একমাত্র ছেলে আরিফ হোসেন সৌদি আরব যান আট মাস আগে। ২০১৬ সাল থেকে প্রবাসী চাচা সাজেদুল ইসলাম আরিফকে নিয়ে যান। কাজের ব্যবস্থা করেন একই কারখানায়। ১৪ জুলাই আল আহসা শহরের হুফুফ শিল্প এলাকার ওই সোফা কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা যান চাচা-ভাতিজা।
স্বামী হারিয়ে সাজেদুলের স্ত্রী শোকে পাথর হলেও ছেলে হারানোর শোক সইতে পারছে না আরিফের মা। এ শোক ক্যাম করে সইবো আরিফের মায়ের এই আর্তনাতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে বারুইপাড়া গ্রামের বাতাস। নিহত আরেকজন ফিরোজ আলী সরদারের বাড়ি পাশের গ্রাম কাতিলা বড় মাধাইমুড়ি। তিনি আনিসুর রহমানের ছেলে। সাড়ে তিন বছর ধরে সৌদি আরবে রয়েছেন ফিরোজ।