তৈরি পোশাকশিল্প খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রেখে আসছে বহু বছর ধরে। এবার এই খাতে সংকট যেন ক্রমেই ঘনীভ‚ত হচ্ছে। বলা চলে, এক ধরনের অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে এবং অত্যন্ত কঠিন সময় পার করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখা এই শিল্পখাত। হাজার হাজার পোশাক শ্রমিক কাজ ফেলে এখন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছেন। বেশ কিছু কারখানায় অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে। বেশ কিছু কারখানা নতুন করে বন্ধ হয়ে গেছে। এতে একদিকে মালিকরা যেমন রপ্তানি হারানোর শঙ্কায় আছেন, তেমনি শ্রমিকরা আছেন মজুরি হারানোর ভয়ে।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে চলা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে অন্তত চার জন শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর এসেছে। বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ হয়েছে। আন্দোলনের কারণে বন্ধ রাখা হয়েছে অনেক কারখানা। এমন পরিস্থিতিতে উত্তরায় বিজিএমএই ভবনে দফায় দফায় বৈঠক করছেন শিল্প মালিকরা। এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ উত্তরার কার্যালয়ে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল রবিবার সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছে।
অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরাও বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে রপ্তানি আয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এর আগে নতুন বেতন কাঠামো প্রত্যাখ্যান করে শ্রমিকদের যে আন্দোলন চলছে, এর বিরুদ্ধে আরও কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিজিএমইএ। বৃহস্পতিবার (৯ নভেম্বর) পোশাক শিল্প মালিকদের এক সমন্বয় সভায় সব কারখানায় নতুন নিয়োগ বন্ধ রাখা, কারখানায় ভাঙচুর হলে প্রয়োজনে অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলা করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এদিকে রাজধানীর মিরপুর ১০, ১৩ ও পল্লবী এলাকার রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ করছে পোশাক কারখানার কয়েকশ শ্রমিক। গতকাল রবিবার সকাল ৮টা থেকে শ্রমিকেরা মিরপুর ১৩ নম্বর সড়কের দুই পাশে অবস্থান করে বিক্ষোভ শুরু করেন।
শ্রমিকরা বলছেন, ন্যূনতম বেতন বাড়ানোর ঘোষণায় তারা সন্তুষ্ট নন। শনিবার (১১ নভেম্বর) কারখানায় কাজে যোগ দিতে গিয়ে দেখেন সবার বেতন সমান হারে বাড়েনি। সরকার ৫৬ শতাংশ বেতন বাড়ানোর ঘোষণা দিলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যারা অভিজ্ঞ শ্রমিক তাদের বেতন বেড়েছে ২০-৩০ শতাংশ। এ কারণে তারা বিক্ষোভ করছেন। এদিকে গাজীপুর মহানগরীর কোনাবাড়ীর জরুন এলাকায় শ্রমিক ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত আরেক শ্রমিক মারা গেছেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শনিবার (১১ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১২টার দিকে মো. জালাল উদ্দিন (৪০) নামের ওই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এর আগে গত বুধবার সকালেও গাজীপুরের কোনাবাড়ী এলাকায় বিক্ষোভরত শ্রমিকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পোশাকশ্রমিকের নাম আঞ্জুয়ারা খাতুন (৩০) গুরুতর আহত হন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পথে মারা যান তিনি।
মজুরি বাড়ানোর আন্দোলনে মারা যাওয়া তিন শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বিজিএমইএ। শনিবার (১১ নভেম্বর) এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তারা এ তথ্য জানিয়েছে। বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান জানান, শ্রমিক আন্দোলন চলাকালে নিহত আঞ্জুয়ারা খাতুন, রাসেল হাওলাদার ও মো. ইমরানের পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তার চেক তুলে দেয়া হয়েছে। উত্তরার বিজিএমইএ কমপ্লেক্সে এসব চেক হস্তান্তর করা হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্যে প্রতিটি পোশাক শ্রমিক গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছে। আমাদের কাছে শ্রমিকদের কল্যাণ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং তাদের অধিকার ও স্বার্থ সমুন্নত রাখতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। তৈরি পোশাকশিল্পকে দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে ফারুক হাসান বলেন, এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একই সঙ্গে নিশ্চিত করেছে প্রায় ৪৪ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। এ ছাড়া পশ্চাৎ ও সম্মুখ সংযোগ শিল্প মিলিয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে পোশাক খাত। এ অর্জনের পেছনে উদ্যোক্তা, শ্রমিক, সরকার, বিদেশি ব্র্যান্ড বা ক্রেতা, উন্নয়ন সহযোগীসহ সংশ্লিষ্ট সবার অবদান রয়েছে।
শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এক বিবৃতিতে ফারুক হাসান জানান, চার দশক ধরে এ দেশে তৈরি পোশাকশিল্প গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন কারণে ৩ হাজার ৯৬৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু করোনার সময়েই ৩১৭টি কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফারুক হাসান বলেছেন, এক সময় বিজিএমইএর সদস্য কারখানা ছিল ৬ হাজার ৮০০টি, এর মধ্যে চালু রয়েছে ২ হাজার ৩৩৯ কারখানা। এর মধ্যে মাত্র ১ হাজার ৬০০টি কারখানা বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে সরাসরি কার্যাদেশ পেয়ে পণ্য রপ্তানি করছে। বাকি কারখানাগুলো সাব-কনট্রাক্টিংয়ের মাধ্যমে, অর্থাৎ যারা সরাসরি কার্যাদেশ পায়, তাদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে নিজেদের ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। বাকি কারখানা নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ ঋণখেলাপি হয়ে গেছেন।
ম্যাপড ইন বাংলাদেশের (এমআইবি) সর্বশেষ তথ্যানুসারে, দেশে বর্তমানে রপ্তানিমুখী ৪ হাজার ১১৪টি তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে পোশাকশিল্প মালিকদের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর সদস্য ২ হাজার ৮৩১। আর এই দুই সংগঠনের সদস্য নয়, এমন কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ২৮৩। তবে এই দুই সংগঠনের বাইরেও বেশ কিছু তৈরি পোশাক কারখানা রয়েছে। এমআইবির তথ্যমতে, বর্তমানে তৈরি পোশাকশিল্প খাতে ৩০ লাখ ৩ হাজার ৫১৭ শ্রমিক কাজ করছেন। যদিও এ সংখ্যা কারও কারও মতে ৪০ লাখের কিছু কমবেশি।
নতুন করে বন্ধ হলো আরও ২০০ কারখানা: বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা এই সেক্টরের উৎপাদন কমে যাচ্ছে। শত শত কারখানা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এই কয়দিনের সহিংস ঘটনায় গাজীপুর ও সাভার-আশুলিয়ায় ভাঙচুরের ঘটনায় নতুন করে প্রায় ২০০টি পোশাক কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে। বিজিএমইএর নেতারা জানান, ভাঙচুরের ফলে শনিবার (১১ নভেম্বর) পর্যন্ত প্রায় ২০০টি কারখানা অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রেখেছেন মালিকরা। গত ৭ নভেম্বর মূল মজুরি ৫৬ দশমিক ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে পোশাক শ্রমিকদের জন্য সাড়ে ১২ হাজার টাকা সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর করছে শ্রমিকদের একটি অংশ। এই প্রেক্ষাপটে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
পোশাক রপ্তানিতে ধাক্কা: তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য বলছে, গত অক্টোবর মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানি কমেছে ১৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবর মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে আয় হয়েছে ১৬ দশমিক ২২ বিলিয়ন ডলারের। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। আগের বছর একই সময়ে ১৪ দশমিক ৭৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল, যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়ে ৮ দশমিক ৮৬ শতাংশ কম। সেপ্টেম্বর মাসে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ।প্রসঙ্গত, ইউরোপ-আমেরিকাসহ প্রধান বাজারগুলোতে কমছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি। এর মধ্যে এককভাবে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৯ মাসে (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পোশাক রপ্তানি কমেছে ২৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে একক মাস হিসেবে শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই রপ্তানি কমেছে প্রায় ৩৫ শতাংশ (৩৪ দশমিক ৭১ শতাংশ)। যুক্তরাষ্ট্রের (ইউএস) ডিপার্টমেন্ট অব কমার্সের অফিস অব টেক্সটাইল অ্যান্ড অ্যাপারেল প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে এই তথ্য জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘সাধারণত দুই মৌসুমের মাঝে অক্টোবর মাসে রপ্তানি কমে। এবার একটু বেশি কমেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে অর্থিনৈতিক মন্দার কারণে। তিনি বলেন, দেশে রাজনৈতিক অবস্থা যদি তৈরি পোশাক কারখানা খোলা রাখা বা রপ্তানিকরণের ক্ষেত্রে বাধা হয়, তাহলে রপ্তানি বৃদ্ধির যে সম্ভাবনা রয়েছে সেটা অর্জন করা কঠিন হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে রপ্তানি আয় কমেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। এতে চলমান ডলার-সংকট আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে দেশে এসেছে ১০ বিলিয়ন বা ১ হাজার কোটি ডলারের রপ্তানি আয়। এই রপ্তানি আয় আগের অর্থবছরের (২০২২-২৩) একই সময়ের ১৩ বিলিয়ন বা ১ হাজার ৩০০ কোটি ডলারের চেয়ে ৩০০ কোটি ডলার কম।
অবশ্য সার্বিকভাবে চলতি অর্থবছরে রপ্তানি বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে রপ্তানি হয়েছে ১ হাজার ৩৬৮ কোটি ডলার, গত বছরের একই সময়ে যা ছিল ১ হাজার ২৪৯ কোটি ডলার। এই তিন মাসে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে সাড়ে ৯ শতাংশ।
এখন আর মজুরি বাড়ানোর সুযোগ নেই: মজুরি বাড়ানোর বিষয়ে শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক মন্ত্রী ও গার্মেন্টস শ্রমিক সমন্বয় পরিষদের আহ্বায়ক শাজাহান খান বলেন, এখন আর মজুরি বাড়ানোর সুযোগ নেই। ফ্যামিলি কার্ড দিয়ে ন্যায্যমূল্যে জিনিস কিনতে পারবেন শ্রমিকরা। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের একাংশের মজুরি নিয়ে চলমান আন্দোলনে তারা ‘ভুল তথ্যে’ বিভ্রান্ত হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেছেন শাজাহান খান।